দ্য ওয়াল ব্যুরো: প্রবীণদের চিকিৎসায় এখনও অনেক ঘাটতি রয়েছে আমাদের দেশে। বয়সকালে নানা রোগ গ্রাস করে শরীর ও মনকে। বার্ধক্যজনিত সমস্যা ছাড়াও ক্রনিক অসুখও থাকে অনেকের। তার ওপর মানসিক নানা পরিবর্তন। করোনার গত দু’বছরে প্রবীণদের শরীর-স্বাস্থ্য ও মানসিক দিকেও অনেক বদল এসেছে। সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে ষাটোর্ধ্ব প্রবীণদের। সংক্রমণের ভয় থেকে ট্রমা, মৃত্যুর আতঙ্ক, পাশাপাশি দীর্ঘ সময় ঘরবন্দি দশায় একাকিত্ব গ্রাস করেছে অনেককে। প্রবীণদের চিকিৎসা, কাউন্সেলিং কীভাবে হবে সে নিয়ে আলাদা প্রশিক্ষণ বা চিকিৎসার ব্যবস্থা এখনও তেমনভাবে নেই আমাদের দেশে। বয়স্কদের আর পাঁচজনের সঙ্গে না মিলিয়ে তাঁদের প্রতিটি সমস্যা গুরুত্ব দিয়ে, যত্ন সহকারে দেখা বা বোঝার জন্য যে প্রশিক্ষণ ও ব্যবস্থা দরকার তারই বড় উদ্যোগ চলছে আমাদের রাজ্যে।

প্রবীণদের চিকিৎসার জন্য যে বিশেষ বিভাগ থাকে তার নাম জেরিয়াট্রিক মেডিসিন। এই জেরিয়াট্রিক কথাটির সঙ্গে অনেকেই তেমনভাবে পরিচিত নন। জেরিয়াট্রিক বিভাগ শুধুমাত্রই বয়স্কদের চিকিৎসার জন্য। সেখানে প্রবীণদের বয়স ও শারীরিক-মানসিক অবস্থা বিচার করে চিকিৎসা করেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ ডাক্তাররা। ওষুধপত্রও সেই হিসেবেই দেওয়া হয়। মানসিক স্বাস্থ্য কথা ভেবে কাউন্সেলিং করানোও হয়। এই জেরিয়াট্রিক মেডিসিন বিভাগের পরিকাঠামোগত উন্নতি ও আরও বেশি প্রচারের জন্যই বিশেষ কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়েছিল। সম্প্রতি কলকাতা মেডিকেল কলেজে জেরিয়াট্রিক মেডিসিন বিভাগ চালু হয়েছে। শহর ও রাজ্যের সর্বত্র এই চিকিৎসা ব্য়বস্থাকে ছড়িয়ে দিতেই দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা জড়ো হয়েছিলেন এই জেরেন্টলজি কনফারেন্সে।

বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ ধীরেশ কুমার চৌধুরী জানিয়েছে, আমাদের দেশে প্রবীণদের সংখ্যা বেড়েছে। তাই তাঁদের প্রতি দায়িত্বও বেড়েছে। শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি বয়সকালে মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রাখাও একটা বড় দিক। প্রবীণদের চিকিৎসায় কী কী দিক রয়েছে, কীভাবে বয়স্কদের চিকিৎসার জন্য আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে সেসব নিয়েই গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কনফারেন্সে আলোচনা করেন বিশিষ্ট চিকিৎসকরা।

চল্লিশ জনেরও বেশি চিকিৎসক প্রবীণদের শারীরিক, মানসিক ও পরিচর্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে আলোপাত করেন। জেরিয়াট্রিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া-র পশ্চিমবঙ্গ শাখার উদ্যোগে আয়োজিত এই সম্মেলনে ভার্চুয়ালি অংশ নেন দেশ ও বিদেশের (আমেরিকা, ব্রিটেন, বাংলাদেশ)  ছয় শতাধিক চিকিৎসক, জেরিয়াট্রিক স্বাস্থ্য কর্মী ও বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা। এই সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন আদ্যাপীঠ রামকৃষ্ণ সংঘের সম্পাদক ব্রহ্মচারী মুরাল ভাই।

সম্মেলনে প্রবীণদের পরিচর্যায় নিযুক্ত কেয়ার গিভার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য “এ গাইড ফর এ জেরিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্কার (কেয়ার গিভার)” একটি গাইড বুকের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হয়। বইটিতে দেশের বিভিন্ন চিকিৎসকেরা খুব সহজ ভাষায় প্রবীণদের পরিচর্যার বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য লিখেছেন।  সংগঠনের সহ সম্পাদক ও বার্ধক্য চিকিৎসক ডাঃ ধীরেশ কুমার চৌধুরী জানান “আমাদের দেশে প্রায় বেশিরভাগ কেয়ার গিভারেরই কোনও প্রশিক্ষণ নেই। এমনকি অনেকের অক্ষর জ্ঞান পর্যন্ত নেই। ফলে তাদের কারণে নানারকম সমস্যা এমনকি মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হচ্ছে প্রবীণ মানুষদের। সরকার ও এই প্রশিক্ষণ বিষয়ে উদাসীন। জেরিয়াট্রিক সোসাইটির মত কিছু সংগঠনের উদ্যোগে বেসরকরি স্তরে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তাই ট্রেনিংয়ের বইটির গুরুত্ব অপরিসীম।”

সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি ও বিশিষ্ট বার্ধক্য চিকিৎসক ডাঃ কৌশিক রঞ্জন দাস বলেছেন “এই বছরের মধ্যেই কলকাতায় জেরিয়াট্রিক ট্রেনিং-এর জন্য বিশেষ সেন্টার খোলা হচ্ছে। দেশের মধ্যে এই ধরনের বিশেষ ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা সম্ভবত প্রথম।”

শহরের অন্যতম দুটি কর্পোরেট হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত এবং বিদেশে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বিশিষ্ট মেডিসিন ও জেরিয়াট্রিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ চিন্ময় কুমার মাইতি বলেন, “এই প্রশিক্ষণ ভীষণভাবে জরুরি। বিদেশে বিশেষ করে ব্রিটেন বা আমেরিকার মতো দেশে প্রবীণদের পরিচর্যা করতে হলে আলাদা প্রশিক্ষণ নিতে হয়। সে পরিবারের লোকজন হলেও।”

সম্মেলনের আয়োজক ও বিশিষ্ট জেরিয়াট্রিসিয়ান ডাঃ কৃষ্ণাঞ্জন চক্রবর্তী জানান, এই বছরের শেষে কলকাতাতে আরও একটি কনফারেন্সের আয়োজন করা হবে। সেখানেও দেশ ও বিদেশের জেরিয়াট্রিসিয়ানরা অংশ নেবেন। প্রবীণদের ভাল রাখতে সবরকমভাবে এগিয়ে আসবে এ শহর।