পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শিকার কি পুরুষরাই!!!…
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিয়ে আলোচনা বারবার হয়ে আসছে দীর্ঘ সময় ধরে। এর বিলোপের কথা বারবার বলা হচ্ছে। সত্যি তো এটা হবেই বা কেন? কেন পুরুষের প্রাধান্য থাকবে? যেখানে পুরুষ ও স্ত্রীর সমান অবদান একটা পরিবার, সমাজ ও দেশ গড়ার ক্ষেত্রে। তবুও কেন মেয়েরা তাদের উপযুক্ত সম্মান, প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হবে!!!
কিন্তু আজকে বলবো এর এক্কেবারে বিপরীত কথা। জানেন কি পুরুষরাই শিকার হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের। কি উল্টা কথা মনে হচ্ছে তো? তাহলে একটু খোলসা করে বলা যাক। কারণ একথাগুলো খুব বেশি জায়গায় আলোচিত হয়না। বাজারি কথায় বললে লোকে খায়না। আবেগ আপ্লুত হয়না। টি আর পি ভ্যালুও কম।
বিশ্বব্যাপী পুরুষ বা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ক্ষমতা, অর্থ, সম্পদের মালিকানা এবং সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারি হিসেবে পুরুষের অবস্থান নারীর উপরে বলে মনে করা হয়। তাই সবাই মনে করেন যে পিতৃতন্ত্র পুরুষকে শুধু সুবিধাই দেয়। কিন্তু নৃবিজ্ঞানী জোবাইদা নাসরিন মনে করেন নিজের তৈরি পিতৃতন্ত্রের বেড়াজালে পুরুষ আসলে নিজেই বন্দী হয়ে রয়েছে। তার ভাষায়, “পুরুষতান্ত্রিকতার শিকার কিন্তু পুরুষরাও। তাদের উপর একটা বাড়তি চাপ থাকে যে তাকে চাকরি পেতেই হবে, সংসারের হাল ধরতে হবে, সে যখন বিয়ে করবে তখন স্ত্রীর খরচ দিতে হবে – একজন পুরুষের কাছে এটা একটা বিশাল মনস্তাত্ত্বিক চাপ।” তিনি আরও মনে করেন সমাজে এটাই প্রচলিত যে চাপের মধ্যে থাকলেও পুরুষের কিছু বলা যাবে না। বললে তাকে দুর্বল মনে করা হবে। ছোটবেলা থেকে তাকে যেভাবে তৈরি করা হয়, পুরুষের যে কাঠামো সেটা কিন্তু পুরুষতান্ত্রিকতারই ছকে তৈরি। পুরুষরা যে পুরুষতান্ত্রিকতার শিকার, এই বেড়াজাল থেকে সে কিভাবে বের হবে সেই পথটা খুঁজে বের করা ভীষণ জরুরি।
আসলে ভীষণ ভাবেই উপেক্ষিত পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য। আর এই বেড়াজাল থেকে বের হতে না পারা, এসব বিষয় নিয়ে কথা না বলা, অথবা বলতে না পারার ফল হলো বিশ্বব্যাপী পুরুষের বেশি আত্মহত্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বব্যাপী নারীদের তুলনায় পুরুষরা দ্বিগুণ (২.৪ গুণ) সংখ্যায় আত্মহত্যা করে। ব্যাপক মানসিক চাপে নানা ধরনের শারীরিক অসুখেও বেশি ভোগেন পুরুষেরা। কিন্তু সে অর্থে সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন না অনেক পুরুষ মানুষই। আসলে পুরুষ হয়ে ওঠার সামাজিক শিক্ষা কিন্তু দেওয়া হয় সমাজ থেকেই। শিশুকাল থেকেই এটা বুঝিয়ে দেওয়া হয় একজন পুরুষ পরিবারের সবার জন্য অর্থ উপার্জন করবে, সবার দায়িত্ব বহন করবে, জীবনে সফল হবে, সবার জন্য সিদ্ধান্ত নেবে। পুরুষের চোখের জল পড়বার অধিকার নেই, দুঃখ প্রকাশ করা যাবেনা, আবেগ প্রবণ হতে পারবে না। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেন পুরুষ হয়ে ওঠার এই সামাজিক শিক্ষা জন্ম থেকেই তার ঘাড়ে বিশাল এক বোঝা চাপিয়ে দেয়। তাই তার কাছ থেকে আশা করা হয় এসব চাপে পুরুষ কখনো ভেঙে পড়বে না। পুরুষ দুর্বলতা প্রকাশ করবে না। আর তাই বিবাহ বিচ্ছেদ হলেও স্ত্রী ও সন্তানদের খোরপোষ বহন করতে হবে পুরুষকে। দায়ী যেই হোক না কেন।
আর এরই ফলাফল গত ২১ বছরের পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে যে ভারতে প্রতি ১০টি আত্মহত্যার মধ্যে ৬ বা ৭ জন পুরুষ। ২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর আত্মহত্যা করেছেন ৪০-৪৮ হাজার মহিলা। যেখানে একই সময়ে আত্মহত্যাকারী পুরুষের সংখ্যা ৬৬ হাজার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখের উপরে। গত বছর ৩০ থেকে ৪৫ বছর বয়সি ৫২,০৫৪ জন আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে প্রায় ৭৮ শতাংশ পুরুষ। একইভাবে, ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সি ৫৬,৫৪৩ জন আত্মহত্যা করেছেন। যার মধ্যে ৬৭ শতাংশ পুরুষ। একই সময়ে, ৪৫ থেকে ৬০ বছর বয়সি ৩০,১৬৩ জন আত্মহত্যা করেছেন, যাদের ৮১ শতাংশের বেশি পুরুষ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে আত্মহত্যাকারীদের বেশিরভাগই বিবাহিত। গত বছর ১,০৯,৭৪৯ জন বিবাহিত আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে প্রায় ৭৪ শতাংশ পুরুষ।
ভারতে আত্মহত্যা প্রতিরোধের কৌশল বিষয়ে বিশ্ব বিখ্যাত স্বাস্থ্য/চিকিৎসা বিষয়ক পত্রিকা – দ্য ল্যানসেট সাইকিয়াট্রি র মার্চ ২০২২ এ যে পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে সেটা সত্যিই চিন্তার। এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে সেটা আরও বেশি।
● মোট আত্মহত্যা (সমস্ত বয়সী) –
◆ ২০১০ – ১৩৪৫৯৯ জন
◆ ২০২০ – ১৫৩০৫২ জন
● প্রবীণ ব্যক্তিদের মধ্যে মোট আত্মহত্যা –
◆ ২০১০ – ১১১০৯
◆ ২০২০ – ১৩১২৬ (১৯·১% বৃদ্ধি)
● প্রবীণ পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যা –
◆ ২০১০ – ৭৯৪১
◆ ২০২০ – ৯৮২৬ (১৮·৩% বৃদ্ধি)
● প্রবীণ মহিলাদের মধ্যে আত্মহত্যা –
◆ ২০১০ – ৩১৬৮
◆ ২০২০ – ৩৩০০
২০১৪ সালে, ৪২,৫২১ মহিলার বিপরীতে ৮৯,১২৯ জন পুরুষ আত্মহত্যা করে মারা গিয়েছিল। এই অনুপাত ২০২১ সালে ২.৬৪ গুণ বেড়েছে। এই বছর ১,১৮,৯৭৯ জন পুরুষ আত্মহত্যা করে মারা গেছেন যেখানে ৪৫,০২৬ জন মহিলা।
https://www.ndtv.com › india-news এ এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ নারীদের তুলনায় ভারতীয় পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার ২.৬ গুণ বেশি।
প্রবীণদের মধ্যে আত্মহত্যা বর্তমানে একটি নীরব মহামারী র মতন –
বিশ্বব্যাপী বয়সের সাথে সাথে আত্মহত্যার হার ক্রমশঃ বাড়ছে। গবেষণা দেখায় যে বয়স্কদের মধ্যে ৪জন আত্মহত্যার প্রচেষ্টার মধ্যে ১জনের মৃত্যু হয়, এবং ২০০জনের প্রচেষ্টার মধ্যে ১ জনের মৃত্যু হয় অল্পবয়সী মধ্যে।
মধ্য ভারতে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ৫৬.৩% প্রবীণ যারা আত্মহত্যা করে মারা গেছেন তারা ৬০-৬৯ বছর বয়সী এবং ৭০-৭৯ বছর বয়সের মধ্যে ৩৩.৭%। চিন্তার বিষয় হল, সমীক্ষায় দেখা গেছে যে এই রিপোর্ট এ করা আত্মহত্যার ৯২% ঘটেছে যখন প্রবীণরা যৌথ পরিবারে বসবাস করছিলেন।
দুর্ব্যবহার, অত্যাচার এবং অবহেলা- ভারতে বয়স্কদের আত্মহত্যার মূল কারণ। হেল্প এজ ইন্ডিয়ার একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে ৫৭% প্রবীণরা চরম অসম্মানের সম্মুখীন, ৩৮% মৌখিক অপব্যবহারের শিকার, এবং ১৩% থাপ্পড় এবং মারধরের মতো শারীরিক নির্যাতনের সম্মুখীন হয় – এমন একটি দেশে যা যেখানে প্রবীণদের একসময় সমাজে পূজনীয় দৃষ্টিতে দেখা হতো। অথচ পরিতাপের বিষয় প্রবীণদের সাথে দুর্ব্যবহার এবং অত্যাচার কার্যত ভারতের প্রতিটি কোণে আজ সংক্রামিত।
অতি সম্প্রতি এবং বিগত বছরগুলোতে সংবাদ পত্রে প্রকাশিত কিছু খবরাখবর এই প্রসঙ্গে উল্লেখনীয়। হয়তো অনেকেরই দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে সেই সংবাদ। কিন্তু ভীষণ ভাবেই সংবেদনশীল তথ্য এবং এবিষয়ে সচেতন হওয়া আশু কর্তব্য।
● হিন্দুস্তান টাইমস, ২৭ আগস্ট, ২০২৩:
“স্ত্রীর অসুস্থতায় হতাশ হয়ে তাকে হত্যা করে বৃদ্ধের আত্মহত্যার চেষ্টা”
● টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২২
“কলকাতায়, প্রবীণ নাগরিক (৭৮ বছর) মারা গেলেন, হাসপাতালে স্ত্রী, সুইসাইড নোট প্রাপ্তি।”
● সংবাদ প্রতিদিন । মহানগর। ২ আগস্ট, ২০১৯
“সাতসকালে দক্ষিণ কলকাতার বহুতল থেকে ঝাঁপ, মৃত্যু ২ প্রৌঢ়ের।”
● টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ৯ মে, ২০১৩
“৭৫ বছরের বৃদ্ধ আত্মহত্যা, স্ত্রী র কব্জি কাঁটা, কিন্তু বেঁচে, কলকাতার খবর।”
● প্রবীণ প্রাপ্তবয়স্কদের আত্মহত্যার অভিপ্রায়ের কারণগুলি কি কি জানা খুবই জরুরি:
◆ জীবন সঙ্গীর বিয়োগজনিত
◆ স্বয়ংসম্পূর্ণতা হারানো
◆ দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা এবং ব্যথা
◆ জ্ঞানীয় বা চিন্তা শক্তির হ্রাস
◆ আর্থিক সমস্যা
● এবারে জেনে নিই বরং লাল পতাকা সতর্কীকরণ চিহ্নগুলি যা নির্দেশ করতে পারে যে কেউ আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছে:
◆ আত্মহত্যা বা মরতে চাওয়ার বিষয়ে কথা বলা।
◆ নিজেকে হত্যা করার উপায় খুঁজছেন এমন কোনো ইঙ্গিত।
◆ অন্যের কাছে বারবার বোঝা হওয়ার কথা বলা।
◆ অ্যালকোহল বা মাদকের ব্যবহার বৃদ্ধি।
◆ উদ্বিগ্ন বা উত্তেজিত আচরণ করা, বেপরোয়া আচরণ করা।
◆ খুব কম বা বেশি ঘুমানো।
◆ সামাজিক ও পারিবারিক জীবন বা অনুষ্ঠান প্রত্যাহার করা বা বিচ্ছিন্ন বোধ করা।
◆ রাগ দেখানো বা প্রতিশোধ চাওয়ার কথা বলা।
◆ মেজাজের চরম পরিবর্তন প্রদর্শন।
● আত্মহত্যার চিন্তায় আক্রান্ত কারোর পাশে কিভাবে কীভাবে দাঁড়াবেন বা প্রতিরোধে সহযোগিতা করবেন:
◆ প্রাক অবসর পরিকল্পনা নিতে সহযোগিতা করা, তাদের সুযোগ করে দেওয়া
◆ সন্দেহ হলে রাখঢাক না করে সরাসরি জিজ্ঞাসা করুন
◆ পাশে থাকা
◆ তাদের নিরাপদ রাখার চেষ্টা, হাতের নাগালে কোনো সহায়ককারী বস্তু বা উপাদান না রাখা।
◆ তাদের সংযোগ করতে সাহায্য করা, যাতে একাকীত্ব অনুভব না হয়
◆ প্রয়োজন হলে বা কোনো সংকেত পেকে অনুসরণ করা
◆ সামাজিক সহায়তা
◆ পারিবারিক সহায়তা
◆ আন্তঃপ্রজন্মীয় সংযোগ
◆ All India Mens Forum – এর মতো সংস্থার সাথে যোগাযোগ
আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত গত ১৭ই নভেম্বর, ২০২৩ তারিখে অল বেঙ্গল মেন্স ফোরাম কর্তৃক আয়োজিত এবছরের থিম “জিরো মেল সুইসাইড” এর উপর ভিত্তি করে পুরুষদের আত্মহত্যার প্রতিকার বিষয়ে এক আলোচনা সভায় প্রবীণ পুরুষদের বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে এই কথা গুলোকেই তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্ট মানুষদের পাশাপাশি আলোচক হিসেবে আমাকে বিবেচনা করার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে প্রবীণদের বিষয়ে আলোচনার সুযোগ করে দেওয়া র জন্য নন্দিনী Mra Nandini Bhattacharjee ম্যাডামকে অশেষ ধন্যবাদ। বাঁচবো কে এই প্রয়াসে সহযোগী সংগঠন হিসেবে নেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
সকলকে আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসের শুভেচ্ছা…
© ডাঃ ধীরেশ।